শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর

১৯৪৭ সালের বৃটিশ ভারত হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামক দুইটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে বৃটিশ শাসন মুক্ত হয়। তন্মধ্যে পাকিস্তান আবার প্রায় বার শত মাইলের ব্যবধানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পাঞ্জাবী শাসক গোষ্ঠী উভয় অঞ্চলেই তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রাখে। ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রায় ২৪ বৎসর কাল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত এবং অবহেলিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শতকরা ৯১ ভাগ ভোট পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপর দিকে তৎকালীন শাসক ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞে মেতে উঠে। এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের আহবান জানান। সেই আন্দোলনে শেরপুরবাসী যে ভূমিকা পালন করে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাকায় নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর শুনে জনতা ২৬ মার্চ সকালে শহরের নিউমার্কেট মোড়ে সমবেত হয় । এ সময় শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। তাদের বক্তব্যে ভীতবিহ্বল ও শোকাহত জনতা দুর্জয় শপথে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। উদ্বেলিত জনতা ‘বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে চারিদিক।

২৭ মার্চ শনিবার । সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের বৈঠক বসে। আলোচনা হতে থাকে । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নকশী ইপিআর ক্যাম্পসহ আশেপাশের ইপিআর ক্যাম্পগুলোতে চলছিল চরম উত্তেজনা । ঢাকায় নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে এলাকার সাধারণ মানুষ । তারা পাঞ্জাবী ইপিআর সদস্যদের তাদের হাতে তুলে দেয়ার আহ্বান জানান । তখন নকশী ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার ছিলেন আব্দুল হাকিম । তিনি প্রথমে মোট ২২ জন পাঞ্জাবী ইপিআর সদস্যকে ক্যাম্পের মসজিদে আটকে রাখেন । শেষ পর্যন্ত নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতে পেরে এদের বিচারের ভার তুলে দেন জনতার আদালতে । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদের ঘন জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয় । এর মধ্যে অবশ্য ২ জন ইপিআর সদস্য পালিয়ে যায়। এদের এক জন গারোকোণা এলাকায় জনতার হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করে অপরজনের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। এরপরই সুবেদার হাকিমকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় ইপিআর পুলিশ , মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সমন্বয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ বাহিনী । একইভাবে অন্যান্য থানা গুলোতেও অস্ত্রসহ পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যরা ছাত্র ও যুব সমাজকে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে থাকেন।

১লা এপ্রিল , ১৯৭১। ভারত সীমানার কাছাকাছি ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কুম্ভিপাতার ক্যাম্পে স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ শিবির। এ শিবিরে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন শেরপুরের ১২ জন নির্ভীক যুবক । এরা হলেন মুমিনুল হক, মোঃ হযরত আলী হজু, আব্দুল ওয়াদুদ অদু, ফরিদুর রহমান ফরিদ, মোকসেদুর রহমান হিমু, কর্ণেল আরিফ, মাসুদ মিয়া, এমদাদুল হক নীলু, হাবিবুর রহমান ফনু, আশরাফ আলী আসাদ, শাহ তালাপতুপ হোসেন মঞ্জু, ইয়াকুব ।

এপ্রিলের ১ম সপ্তাহেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে সৌজন্যমূলক অস্ত্র পাওয়া যায়। সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এসব অস্ত্র হস্তান্তর করা হয় মধুপুরে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রারোধে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে । পাশাপাশি সুবেদার হাকিমের নেতৃত্বে ইপিআর ,পুলিশ, আনসার মুজাহিদদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ একটি দলকে পাঠানো হয় মধুপুরে । এদিকে একের পর এক খবর আসতে থাকে প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙ্গে পড়ার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসে শেরপুর ,নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে । সংগ্রাম পরিষদের লোকজন এসব মানুষের জন্য কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আশ্রয়কেন্দ্র খোলেন। তখন কেন্দ্রটির তদারকির দায়িত্ব পড়েছিল আব্দুল মোতালেবের উপর ( পরবর্তী কালে শহীদ) । থানা এলাকাগুলোতেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়।

১৫ এপ্রিল, ১৯৭১। মধুপুরের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। তাই এটিকে সরিয়ে এনে প্রথমে জামালপুরের দিগপাইতে ও পরে শেরপুরের চরাঞ্চলে স্থাপন করা হয়। ২০ এপ্রিল , হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে মারাত্মকভাবে প্রতিরোধ বাহিনীর উপর শেলিং করে। এতে ১৩ জন সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তি হতাহত হয়। সারা শেরপুরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহরের আবাস ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যেতে থাকে গ্রামে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে নেতৃবৃন্দ। কেননা যারা ভারত যেতে চাচ্ছে, তাদেরকে বাধা প্রদান করছে পাকিস্তানের পদলেহনকারী দালালরা। এমন সময় সুবেদার হাকিম শেরপুরে এলেন। তিনি যারা দেশত্যাগ করছে , তাদের নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিলেন। মাইকযোগে এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর ২২ এপ্রিল ,ভোর ৫ টা থেকে মুক্তিকামী শেরপুরবাসী ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ২৭ টি বাস-ট্রাক যোগে শুরু হওয়া এ যাত্রা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ।

২৬ এপ্রিল ১৯৭১। পাক হানাদার বাহিনী গুলি করতে করতে শেরপুর শহরে প্রবেশ করে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার মাধ্যমে শেরপুর দখলে নিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে নয়ানী জমিদার বাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের অফিস)। এদিকে শহীদ হন মোস্তফা ও বুলবুল নামের ২ জন ছাত্র । শহীদ হন রুটি বিক্রেতা আহমদ আলী, শনি বিগ্রহ মন্দিরের পুরোহিত সুব্রত ভট্টাচার্যসহ নাম না জানা অনেকে। এছাড়াও ঐ একই দিনে হানাদার বাহিনী ঝাউগড়া গ্রামে হানা দিয়ে শহর থেকে আসা আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যবসায়ী চৌথমল কারুয়া, নিপু সাহা, মহেন্দ্র দে সহ ৮ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এক সপ্তাহের মধ্যেই হানাদার বাহিনীরা প্রতিটি থানা সদরসহ সীমান্ত চৌকিগুলোতে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। ঝিনাইগাতীর আহমদ নগর ছিল পাক হানাদারদের সেক্টর, হেডকোয়ার্টার। ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাগণ ভারতে তুরা, মহেন্দ্রগঞ্জ, ডালু, ট্রেনিং শেষে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাক হানাদার বাহিনীরা কিছু কিছু জায়গায় গণহত্যায় মেতে উঠে। যথাক্রমে জগৎপুর গণহত্যা, নাকুগাও ডালু গণহত্যা , সোহাগপুর গণহত্যা, নকশী যুদ্ধ ও গণহত্যা, নারায়ন খোলা যুদ্ধ ও গণহত্যা , সর্বশেষে ২৪ শে নভেম্বর শেরপুর সদর উপজেলায় সূর্যদীর গণহত্যায় মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক বেসামরিক জনগণ শহীদ হন ।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসে শেরপুরের বিভিন্ন স্থানে নিম্মোক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ শহীদ হন।

শেরপুর সদর উপজেলায়ঃ১।নাজমুল হোসেন বুলবুল ২। আশরাফুল আলম ৩। তালেব আলী ৪। আফছর আলী ৫। গোলাম মোস্তফা ৬। আক্তার হোসেন ৭। কামাল উদ্দিন ৮। আব্দুল্লাহ আবু মোতালেব
নকলা উপজেলায়ঃ১। আকবর আলী ২। ইয়াদ আলী ৩। সুরুজ্জামান (ডাকাতিয়াকান্দা ) ৪। জামাল উদ্দিন ৫। আব্দুর রশীদ ৬। সুরুজ্জামান (লয়খা) ৭। জমশেদ আলী ৮। হযরত আলী ৯। ইদ্রিস আলী ১০। হাসমত আলী ১১। সুলতান মিয়া ১২। সিরাজুল ইসলাম (মঞ্জু) ১৩। ছাইয়েদুর রহমান ১৪। আনোয়ারুল হক ১৫। আজিজুল হক ১৬। ওয়াহেদ আলী ১৭। দুলাল উদ্দিন।
শ্রীবরদী উপজেলায়ঃ১। নুর ইসলাম ২। আঃ হামিদ ৩। ইসমাইল হোসেন ৪। তৈয়বুর রহমান ৫। শাহ জাহান ৬। আব্দুল বারেক ৭। সোনা মিয়া ৮। শফি উদ্দিন ৯। আব্দুল কাদের ১০। হযরত আলী ১১। তোজাম্মেল হোসেন ১২। আব্দুছ ছালাম ১৩। আব্দুল জববার ১৪। সাজ উদ্দিন ১৫। আঃ আওয়াল ১৬। শাহ মোতাসীম বিল­াহ খুররম বীর বিক্রম ।
নালিতাবাড়ী উপজেলাঃ১। শামছুল ইসলাম ২। নূর মোহাম্মদ ৩। আলতাফ হোসেন ৪। চাঁন মিয়া ৫। ডাঃ খালেক ৬। মফিজ উদ্দিন ৭। জসিম উদ্দিন ৮। আলাউদ্দিন ৯। ইছব আলী ১০। আফছার আলী ১১। এন. এম. নাজমুল আহসান ১২। আনোয়ার আলী ।
ঝিনাইগাতী উপজেলায়ঃ১। ছাইফুর রহমান ২। রফিকুল ইসলাম ৩। আলফাজ উদ্দিন ৪। নুর মোহাম্মদ ৫। পরিমল চন্দ্র দে ৬। মোফাজ্জল হোসেন(অসমাপ্ত তালিকা)
মুক্ত শেরপুরঃমুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথ নেতৃত্বে পাকহানাদারদের দখল হতে শেরপুর জেলা মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। গৌরব গাঁথা সে দিনটির কথা শেরপুরবাসীর স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে আজও ।এইদিনে একদিকে বিজয়ের অনাবিল আনন্দ,অপরদিকে স্বজনহারাদের আহাজারি এর মাঝে শহরের শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্কে হেলিকপ্টারযোগে অবতরণ করেছিল ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা । এখানে দাঁড়িয়েই তিনি বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ,মস্কো, আকাশবাণী সহ বিভিন্ন বেতার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন । তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি শেরপুর জেলার আপামর জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময়, গৌরবোজ্জ্বল ও অবিস্মরণীয় দিন । স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস জেলার বর্তমান ৫টি উপজেলার ৩০/৪০টি এলাকায় ছোট বড় যুদ্ধ হয়েছে। পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। মূলতঃ নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই এ জেলার শত্রু সেনাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে ।৩ ডিসেম্বর শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী সীমান্ত ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী, মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণে হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা তাদের ঘাঁটিগুলোতে রাজাকার-আলবদরদের রেখে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করে জামালপুরের দিকে। তাই অনেকটা বিনা বাধায় ঝিনাইগাতী ৪ ডিসেম্বর, শ্রীবরদী ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। টানা ২ দিন যুদ্ধের পর ৭ ডিসেম্বর ও একই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী বেশে শেরপুর প্রবেশ করে। আরও ১দিন পর ৮ ডিসেম্বর প্রবেশ করে নকলায়। সবার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের আলো। শেরপুর মুক্ত , শেরপুর স্বাধীন । শত শত মুক্তিযোদ্ধার সে কী আনন্দ নৃত্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য এ জেলার ১ জন বীর বীরবিক্রম, ২ জন বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন। এরা হলেন, ‘শহীদ শাহ মোতাসীম বিল­াহ খুররম বীর বিক্রম’, ‘কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি বীর প্রতীক’ ও ডাঃ মাহমুদুর রহমান বীর প্রতীক। এ তিন বীর সন্তানই শ্রীবরদী উপজেলার বাসিন্দা।