মানিকগঞ্জের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

ড. অমর্ত্য সেন

( জন্ম-১৯৩৩- )

        মানিকগঞ্জ জেলার যে কৃতি সন্তান সমগ্র বিশ্বময় তাঁর নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করাতে সমর্থ হয়েছেন তিনি বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য কুমার সেন। তাঁর নিজ বাড়ী মানিকগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী মত্ত গ্রামে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে গণভবনে সংবর্ধনা জানান এবং নোবেল বিজয়ী মানিকগঞ্জের ছেলে অমর্ত্য সেনকে সম্মাননা নাগরিকত্ব প্রদান করেন। শৈশবে দেশ ত্যাগ করে গেলেও অমর্ত্য সেন আজ বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিক। অমর্ত্য সেন শুধু একজন প্রথা মাফিক অর্থনীতিবিদ নন, তিনি অর্থনীতির দার্শনিক ও বিবেক। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর। তাঁর ডাক নাম বাবলু। অমর্ত্য সেনের ছোট বেলা কেটেছে ঢাকা, শান্তিনিকেতন, বার্মার মান্দালয় এবং কলকাতায়। তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। বস্ত্তত তাঁর মত এত বেশী ডক্টরেট ডিগ্রি পৃথিবীতে আর কেউ পেয়েছেন কিনা তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লীর নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৩ সালে জিন মেয়ার গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড অব এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯৯৭ সালে এডিনবার্গ মেডেল, ক্যাটালোনিয়া ইন্টারন্যাশন্যাল প্রাইজ এবং নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। অমর্ত্য সেন তাঁর শিক্ষা জীবনে ক্যামব্রিজ অ্যাডাম স্মিথ প্রাইজ (১৯৫৪), রেনবারি স্কলারশিপ (১৯৫৫), স্টিভেশন প্রাইজ (১৯৫৬), ট্রিনিটি সিনিয়র স্কলারশিপ (১৯৫৪), রিসার্চ স্কলারশিপ (১৯৫৫), প্রাইজ ফেলোশিপ (১৯৫৭) লাভ করেন।

 

শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ

(১৯২৬-১৯৫২)

ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে যে সন্তান সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঋণী করেছেন, মানিকগঞ্জকে গৌরবান্বিত করেছেন তাঁর নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। তিনি ১৯২৬ সালের ৩০ শে অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামে  জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল লতিফ, মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। তিনি ১৯৪৯ সালে বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তারপর আসে বাহান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারী। ঐদিন পাক সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল করার সময় তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় (বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে) রফিকই প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। তাই বলা যায় তিনিই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। রফিক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন। কলকাতায় থাকাকালে তিনি পারিল-বলধারা যুবক সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি এখন শহীদ রফিক হয়ে পনের কোটি মানুষের অন্তরে বিরাজমান। তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছিল আজিমপুর গোরস্থানে।

বিচারপতি এ. কে. এম নূরুল ইসলাম

জন্ম-১৯২৫

         মানিকগঞ্জের যে মাণিক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তাঁর নাম বিচারপতি এ.কে.এম নূরুল ইসলাম। তিনি ১৯২৫ সালে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার পূর্ব খলিলপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪১ সালে মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৫ সালে ইংরেজি অনার্স সহ বি.এ ডিগ্রী নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে তিনি এম. এ পাশ করেন। তিনি তদানীন্তন ঢাকা হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে ১৯৬৮ সালের ২১ শে অক্টোবর শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৯৭০ সালে স্থায়ী বিচারপতি নিযুক্ত হন। বিচারপতি এ. কে. এম নূরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালের ৮ই জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বারের মত উক্ত পদে নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকা সিটি ‘ল’ কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং এই কলেজের একজন সিনিয়র অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মানিকগঞ্জ-২ নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৯৮৬ সালের ২৬ শে আগস্ট অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের ৩০শে নভেম্বর তিনি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।

কর্ণেল (অবঃ) এম. এ মালেক

(১৯৩৫-২০০০)

বিশিষ্ট সমাজসেবক কর্ণেল (অবঃ) এম. এ মালেক, পি.এস.সি, মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়নের চান্দইর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৫ সালের পহেলা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম এম, কে মোল্লা এবং মাতার নাম বেগম ইসাতুন্নেছা। তিনি মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রি্ক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি দেবেন্দ্র কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৭৫ সালে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেন। মানিকগঞ্জ-সাটুরিয়া নির্বাচনী এলাকা হতে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৬ সন থেকে ১৯৮৯ সন পর্যন্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে বস্ত্রমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রী পরিষদে যোগদান করেন। বিশাল মনের অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্বকে বলা হয় মানিকগঞ্জের উন্নয়নের রূপকার, যিনি মানিকগঞ্জের উন্নয়নে এবং গরীব, দুঃখী, অসহায়, দুঃস্থ মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি ২০০০ সালের ১৬ ই জুলাই তারিখ ভোর ৫টায় জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী

(১৯২৮-১৯৮৭)

ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী মানিকগঞ্জ জেলার এক অমর কৃতী সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী শিবালয় থানার এলাচিপুর গ্রামে। তাঁর পিতা আব্দুল মতিন চৌধুরী, মা হাসিনা চৌধুরী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ১৯৫০ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সামরিক অফিসার। ১৯৫০-৬২ সময়ে ১ম পাঞ্জাব রেজিমেন্টে এডজুট্যান্ট ও কোয়ার্টার মাস্টার, চতুর্দশ ডিভিশনের জিওসি’র এডিসি এবং তদানীন্তন  পূর্ব পাকিস্তান ইউ-ও-টি-সি ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯৬২ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৫ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। মন্ত্রী হিসাবে সর্বশেষে তিনি কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি দান করে। ২৫ তারিখ দিবাগত রাত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মানিকগঞ্জ জেলার স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির সমন্বয়ে সাত সদস্যের একটি কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হয়। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ২২টি থানার সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা সদর ও গাজীপুরে এরিয়া কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই মহান বীর সেনানী ১৯৮৭ সালের ৭ই অক্টোবর পরলোক গমন করেন।

হীরালাল সেন

(১৮৬৭-১৯১৭)

বাংলার চলচ্চিত্র জগতের প্রবাদ পুরুষ হীরালাল সেন। মানিকগঞ্জ জেলার বকজুরি গ্রামে ১৮৬৭ সালে আগস্ট মাসের শ্রাবণী পূর্ণিমায় মুন্সি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবি ও ডাকসাইটে জমিদার চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন হীরালাল  সেনের পিতা। হীরালাল সেনের শৈশব কেটেছে মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে পড়াশুনা করে । এরপর তিনি ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। বকজুরিতে হীরালাল সেনের কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলে গড়ে ওঠে ‘‘অমরাবতী ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন’’ । তিনি ১৮৯৭ সালে গ্রাম বাংলাকে নিয়ে একটি তথ্য চিত্র তৈরী করেন। ১৮৯৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানীতে শুরু হয় নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। এখানকার প্রদর্শিত প্রথম ছবি ‘‘আলিবাবা’’ ঢাকা শহরে ১৮৯৮ সালে ১৭ ই এপ্রিল প্রদর্শিত হয়। ১৯০২ সালে হীরালাল সেন চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯১২ সালে ‘দরবার’ ও ‘রয়াল ভিজিট’ নামে দুটি সংবাদমূলক তথ্যচিত্র তৈরী করেছিলেন। বম্বে থেকে ১৯১২ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মতে বিভিন্ন জায়গায় তিনি প্রায় ৮০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর এই নির্মাণ কাজ চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এবং উপমহাদেশেও তিনি চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে আজও বিরাজমান। ১৯১৭ সালের ২৯ শে অক্টোবর চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ হীরালাল সেন চির নিদ্রায় শায়িত হন।

খান আতাউর রহমান

(১৯২৮-১৯৯৭)

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান বাঙালী জাতির অহংকার। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে। তিনি এ্রকাধারে গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক, সার্থক অভিনেতা, কবি ও সাহিত্যিক। সংস্কৃতির সকল শাখায় ছিল তাঁর বিচরণ এবং প্রতিটি শাখাতেই তিনি সফল। খান আতা ১৯৪৪ সালে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এস.সিতে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে খান আতা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক ভাবে জড়িয়ে পড়েন। খান আতা ১৯৫৩ সালে লন্ডনের পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশনের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। খান আতা বেতারের জন্য বহু গান লিখেছেন। খান আতা ১৯৫৯ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘‘এদেশ তোমার আমার’’ ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর শেষ ছবি ‘‘এখনও অনেক রাত’’ মুক্তি লাভ করে ১২ই নভেম্বর, ১৯৯৭ সনে। তিনি জীবনে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর প্রতিটি ছবিই দেশ ও সমাজের জন্য দিক নির্দেশক। এই অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব ১৯৯৭ সালের ১লা ডিসেম্বর ঢাকায় পরলোক গমন করেন।

 

ফোক শিল্পী কিরণচন্দ্র রায়

 

জন্মঃ ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই

    দেশ বিদেশে নন্দিত বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত এবং ফোক শিল্পী কিরণচন্দ্র রায় মানিকগঞ্জের সন্তান।৩৫ বছর আগে কিরণচন্দ্র রায় গলায় তুলে নিয়েছিলেন বাউলগান। হাতে ধরেছিলেন একতারা, খঞ্জনি আর খমক।গায়ে গেরুয়া পোশাক। আজও দেশ বিদেশের নানা প্রান্তে গেয়ে বেড়ান লোকগান।

   তিনি ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবার নাম জুরানচন্দ্র রায় মায়ের নাম মুক্তা রায়।কিরণচন্দ্র রায়ের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হরিরামপুর উপজেলার ভাটি বায়রা ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে। পাটগ্রাম আনাথ বন্ধু হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে।
তিনি তার কাকা প্রভাতকুমার রায়ের কাছে পেয়েছিলেন সংগীতের হাতেখড়ি এরপর মানিকগঞ্জের দোতারা বাদক চান মিয়ার মাধ্যমে ।তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কবি জসিমউদ্দীনের সাথে।জসিমউদ্দীন তার গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাকে বাংলাদেশ বেতারে গান গাইবার সুযোগ করে দেন। এরপর
কিরণচন্দ্র রায়কে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্পেশাল গ্রেডের শিল্পী হয়ে উঠেন। বাউল গান, লোক গীতি, বৈষ্ণব পদাবলী ও কৌতূক গীতিতে তার জুরি মেলা ভার। জনপ্রিয় এই শিল্পী কাজ করেছেন সমাজ সচেতনতা মুলক “যক্ষ্মা মুক্ত বাংলাদেশ” এই বিজ্ঞাপন। সি, ব্রাদার ও কনকর্ড ছাড়াও আরো আনেক জনপ্রিয় ক্যাসেট কোম্পানি তার ক্যাসেট বের করেছে।কিরণচন্দ্র রায় একজন পেশাগত সংগীত শিল্পী হলেও তার মুল
পেশা শিক্ষকতা। তিনি আরমানীটোলা সরকারী হাইস্কুলের একজন শিক্ষক এবং লালন পরিষদের সংগীত বিভাগের অধ্যক্ষরুপে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিরণচন্দ্র রায় বিবাহ করেছেন আরেক সংগীত শিল্পী চন্দ্রনা মজুমদারকে। তিনি তার জীবনে পেয়েছেন বহু পুরষ্কার বহু সম্মান এবং গর্বিত করেছেন আমাদের মানিকগঞ্জকে।

কন্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম

জন্ম-১৯৭৬

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের উজ্জ্বল নক্ষত্র কন্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের জন্ম ১৯৭৬ সালের ৫ মে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার জয়মন্টপ ইউনিয়নের ভাকুম গ্রামের এক সংগীত পরিবারে। বাবা সে সময়ের বাউল-জারী-সারী গানের বিখ্যাত শিল্পী মরহুম মধু বয়াতী এবং মা উজালা বেগম। দাদা  মরহুম আলম বেপারী ছিলেন বৈঠকী গানের শিল্পী। মমতাজের গানের হাতেখড়ি বাবা মধু বয়াতীর কাছে শিশুকালে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বাবার সাথে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। পপ সম্রাজ্ঞী খ্যাত সারাদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় এ শিল্পী এখন বিশ্বব্যাপী নন্দিত। জনসেবা ও জনসচেতনতামূলক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে ইতোমধ্যেই গ্রাম বাংলার লক্ষ কোটি মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করেছেন। সেই ভালোবাসা ও আস্থার স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নবম জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেন। মানিকগঞ্জ শহরে ২০০৪ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মমতাজ চক্ষু হাসপাতাল’। তাছাড়া সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে ২০০৮ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মমতাজ শিশু ও চক্ষু হাসপাতাল’ নামে আরেকটি হাসপাতাল।

কিশোরীলাল রায় চৌধুরী

(১৮৪৮-১৯২৫)

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। ১৮৪৮ সালের ১৯শে নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটি জমিদার পরিবারের প্রখ্যাত পশ্চিম বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহাত্মা জগন্নাথ রায় চৌধুরী। জনহিতকর কাজে তিনি ছিলেন অগ্রনায়ক। তিনি ১৮৮৪ সালের ৪ঠা জুলাই তাঁর পিতার নামে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি। বালিয়াটির প্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীযুক্ত কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ঢাকায় বাংলা বাজারে ১৮৮৭ সালে তাঁর নিজ নামে কিশোরীলাল জুবিলী হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নাট্য চর্চার উন্নতির জন্য মালঞ্চ নামে ঢাকাতে তিনি একটি রঙ্গমঞ্চ গড়ে তোলেন। সেই  রঙ্গমঞ্চটি বর্তমানে লায়ন্স সিনেমা নামে পরিচিত। বালিয়াটিতে তিনি একটি দাতব্য চিকিঃসালয় স্থাপন করেন যা অদ্যাবধি সরকারী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯২৫ সালের ৩ জুলাই বাবু কিশোরীলাল রায় চৌধুরী পরলোকগমন করেন।

 

আর.পি. সাহা

(১৮৯৬-১৯৭১)

যে কর্মবীরের কল্যাণে মানিকগঞ্জের বহু মানুষ উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, যার অনেকেই মানিক হবার জোগ্যতা অর্জন করেছেন, সে মহান সমাজসেবকের নাম রনদা প্রসাদ সাহা। মানুষের কাছে তিনি আর,পি সাহা নামেই বেশি পরিচিত। তিনি মানিকগঞ্জের সন্তান নন, তবে জামাতা। বিয়ে করেছিলেন বালিয়াটির বিখ্যাত জমিদার পরিবারের কন্যা শ্রীমতি কিরণ বালা সাহাকে।
১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাছৈড় গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী। দেবেন্দ্রনাথ টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামের অধিবাসী দেবেন্দ্র নাথ উইল লেখক হিসেবে কাজ করতেন।
রণদা মাত্র সাত বছর বয়সে মাতৃহারা হন। তৃতীয় শ্রেনির পর রণদার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। কিশোর রণদা বাড়ী থেকে পালিয়ে কলকাতা যান এবং তিনি বিভিন্ন ধরনের কায়িক শ্রম যেমন- কুলি, শ্রমিক, রিক্সা চালক, ফেরিওয়ালার প্রভৃতির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এক পর্যায়ে রণদা জাতীয়তাবাদী বা স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন ও কিছুদিন হাজতবাসও করেন। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারত থেকেও অসংখ্য তরুন যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নাম লিখায়। যুদ্ধ শেষ করে এবং রনদা সেনাবাহিনীর জীবনের ইতি করে ১৯২০ সালের ১৫ অক্টোবর কলকাতা ফেরৎ আসেন। যুদ্ধফেরৎ সৈনিকদের জন্য সরকার থেকে যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। রণদা রেলবিভাগে টিকেট কালেক্টর পদে চাকুরি পান। অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে কলকাতায় তিনি কয়লা ও লবনের ব্যবসা শুরু করেন। এসময় নদী পথে চালিত লঞ্চসমূহের ইঞ্জিন কয়লা দ্বারা চালিত হতো। ১৯৩৯ সালে জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, জাস্টিস জে.এন. মজুমদার ও নলিনী রঞ্চন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে রণদা প্রসাদ ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ নামে একটি নৌ-পরিবহণ কোম্পানি চালু করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্য শরিকদের কাছ থেকে সকল অংশ কিনে নিয়ে কোম্পানির একক মালিকানা লাভ করেন।
১৯৪০ সালে রণদা নারায়ণগঞ্জস্থ জর্জ অ্যান্ডারসনের যাবতীয় পাট ব্যবসা কিনে নেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সরকার প্রচুর খাদ্য সংগ্রহ ও মজুদের জন্য সারা বাংলায় ৪ জন প্রতিনিধি নিয়োগ করে। রণদা প্রসাদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ ব্যবসায়ও তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। এভাবে দেশ বিভাগের পূর্বেই রণদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রুপান্তরিত হওয়ার পরও তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবা প্রদান অব্যাহত রাখেন। ১৯৩৮ সালে মির্জাপুরে তিনি তাঁর মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করেন রণদা প্রসাদ কুমুদিনী হাসপাতালের সাথে একটি মহিলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ২০০১ সালে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ১৯৩৮ সালে আর,পি সাহা ২০০ ছাত্রীর আবাসিক সুবিধাসহ একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯৪৫ সালে বালিকা বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হলে তাঁর প্রপিতামহীর নামে নামকরণ হয় “ভারতেশ্বরী হোমস” । যা বর্তমান বাংলাদেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৩ সালে রণদা টাঙ্গাইলে মেয়েদের জন্য কুমুদিনী কলেজ স্থাপন করেন।
১৯৪৬ সালে তিনি পিতার নামে মানিকগঞ্জে “দেবেন্দ্র কলেজ” প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৭ সালে রণদা তার সকল ব্যবসা, কল-কারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার জন্য ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ গঠন করেন। ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয় নারায়নগঞ্জে অবস্থিত এবং ট্রাস্টটি ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ যাত্রা শুরু করে।
বৃটিশ সরকারকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানের জন্য রণদা ১৯৪৪ সালে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার সমাজ সেবার জন্য তাঁকে ‘হেলাল এ পাকিস্তান’ খেতাব প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে রণদা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাব স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৮৪ সালে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করে। বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালে রণদা প্রসাদের স্বরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
১৯৭১ সালের ৭ মে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী সহযোগীরা মির্জাপুর থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এই মহান ব্যাক্তির প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তার প্রতি আমাদের পাতার পক্ষ থেকে রইল অগনিত সম্মান ও ভালবাসা। তার কর্মে আমরা ঋণী।