শেরপুর জেলার ঐতিহ্য

ঘাগড়া খান বাড়ি মসজিদঃ নির্মাণকাল আনুমানিক ৬০০ বৎসর পূর্বে । কথিত আছে ‘পালানো খা’ ও ‘জববার খা’ দুই সহোদর কোন এক রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন। পরাজিত হয়ে ভ্রাতৃদ্বয় এই অরণ্যে আশ্রয় নেন এবং সেখানে এই মসজিদটি স্থাপন করেন। মসজিদটির বিশেষত্ব হল যে এর ইটগুলো চারকোণা টালির মত। আজ হতে ছয় থেকে সাতশত বৎসর পূর্বে এই ইটগুলির ব্যবহার ছিল। আস্তরণ বা পলেস্তার ঝিনুক চূর্ণ অথবা ঝিনুকের লালার সাথে সুড়কী, পাট বা তন্তু জাতীয় আঁশ ব্যবহার করেছে। এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির নির্মাণ কৌশল গ্রীক ও কোরিন থিয়ান রীতির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় । প্রবেশ পথের উপর রয়েছে আরবী ভাষায় নির্মাণকাল ও পরিচয় শিলা লিপি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, সেই যুগেও দক্ষ স্থপতি এ অঞ্চলে ছিল। মসজিদটি পুরাকীর্তির এক অনন্য নিদর্শন। যা দেখে যে কোন পর্যটক আকৃষ্ট হবেন, বিমোহিত হবেন। 

মাই সাহেবা মসজিদঃ নির্মাণকাল  আনুমানিক  ২৫০ বৎসর  পূর্বে  । এটিও  এ  জেলার  প্রাচীন  নিদর্শনের একটি। বর্তমানে  মসজিদটি আধুনিক ভাবধারায়  পুনঃ নির্মাণ  হয়েছে।  বক্রাকারে  খিলানের ব্যবহার  এবং  সুউচ্চ মীনার ২টি  সত্যি দৃষ্টিনন্দিত। স্থাপত্য  কলার  আধুনিক  পরিবর্তন   লক্ষ্য  করা যায়  এই মসজিদটিতে। এটি শেরপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে শেরপুর সরকারি কলেজর দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে অবস্থিত। শেরপুর শহরের প্রবেশের সময় এর মিনার দুইটি অনেক দূর থেকেও দেখা যায় । বিশাল এই  মসজিদের সামনের অংশে অনেক জায়গা রয়েছে। এখানে প্রতি বছর ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শেরপুর শহরে প্রবেশের পর যে কারো এই মসজিদটি দৃষ্টি কাড়বে।

গড়জরিপা বার  দুয়ারী মসজিদঃ স্থাপত্য নিদর্শনের অন্যতম  গড় জরিপা বার দুয়ারী মসজিদ । এটিও  এ অঞ্চলের  ঐতিহ্য । জনশ্রুতিতে আনুমানিক  ৭-৮ শত বৎসর পূর্বে জরিপ শাহ  নামক  এক মুসলিম  শাসক  কতৃক  নির্মিত  হয়েছিল এই মসজিদটি। তবে  এটি বর্তমানে  পুনঃ নির্মাণ  করা হয়েছে। আসল মসজিদটি ভূ-গর্ভেই রয়ে গেছে। তার উপরেই  স্থাপিত  হয়েছে বর্তমান মসজিদটি।  জামালপুর সদর উপজেলার তীতপল্লী ইউনিয়নের পিঙ্গলহাটী(কুতুবনগর) গ্রামের (ব্রাহ্মণ ঝি বিলের উত্তর পাড়ে) জনৈক  পীর  আজিজুল হক ছাহেব খনন কার্য  চালান এবং  বের করেন  মসজিদের ধ্বংসাবশেষ । মসজিদটির ইটের ধরণ কৌশলে খান বাড়ী মসজিদের ইটের  সাথে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায় । প্রাচীন রীতির সাথে  আধুনিক রীতির সংমিশ্রণে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে  যা  সহজেই দর্শকদের মন জয় করে। অপরূপ সুন্দর এই   মসজিদটি আসলে    পুরাকীর্তির নিদর্শন । ১২টি দরজা থাকায়  এর নামকরণ করা  হয় বার  দুয়ারী মসজিদ। পূর্বেও  তাই ছিল। অপূর্ব কারুকাজ  সম্বলিত মেহরাব ও  কার্ণিশ গুলো  সকলের দৃষ্টি কাড়ে। এছাড়াও  কিছু দূরে  জরিপ শাহ এর মাজার  অবস্থিত । এর অনতিদূরে  কালিদহ সাগর  রয়েছে। জনশ্রুতিতে  আছে চাঁন্দ  সওদাগরের ডিঙ্গা  এখানেই  ডুবেছিল। নৌকার আদলে  কিছু একটা  অনুমান করা যায়  এখনও । অঞ্চলটিতে  একবার  ঘুরে এলে যে কোন  চিন্তাশীল   মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে। খনন কার্য  চালালে  হয়তো  বেরিয়ে আসবে  এ অঞ্চলের হাজার বৎসরের  প্রাচীন  সভ্যতার নানা উপকরণ ।

পৌনে তিন আনী জমিদার বাড়িঃ জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী  ও  জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর  বাড়িকে বলা হত  পৌনে তিন আনি জমিদার বাড়ি। গ্রীক স্থাপত্যের  অনুকরণে নির্মিত স্থাপত্যটি এখনো অক্ষত অবস্থার সাক্ষ্য বহন করছে জমিদারী আমলের । এ  বাড়িটির  নির্মাণ কাল গোপীনাথ  মন্দির নির্মাণেরও অনেক পূর্বে । সুপ্রশস্ত বেদী । প্রবেশ পথে অনেকগুলো ধাপ । প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে অনেক গুলো  অলংকৃত স্তম্ভ । স্তম্ভগুলির নিচ থেকে উপর    পর্যস্ত কারুকাজ খচিত নকশা । কার্ণিশেও  বিভিন্ন  প্রকারের  মটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। তা ভবনটিকে অনেক আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চার পাশের স্তম্ভগুলো  চতুষ্কোণ বিশিষ্ট এবং এতে বর্গাকৃতি  ফর্ম ব্যবহার  করা হয়েছে।  আস্তরণ ও পলেস্তারে চুন ও সুড়কীর ব্যবহার লক্ষণীয় । ছাদগুলিতে  গতানুগতিক ভাবে লোহার রেলিং  এর সাথে  চুন সুড়কীর ঢালাই ।

রং মহলঃ জমিদার বাড়ির ঠিক  দক্ষিণ  পূর্ব কোণে অবস্থিত রং মহল । যা দেখে সহজেই  ধারণা করা যায় জমিদাররা ছিল সংস্কৃতি প্রিয়। নাচ-গানের প্রতি ছিল অনুরাগ । ফলে অনেক জমিদার বাড়িতেই  রং মহল ছিল। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি  এই স্থাপত্যটিতে রয়েছে  অনেক গুলো  কাঠের  জানালা । জানালার  উপরে  দর্শানীয়  ভেন্টিলেশনের ব্যবহারও রয়েছে  যা ইচ্ছা মত ব্যবহার করা য়ায় । এ ছাড়াও ছাদের নিচের অংশে  কাঁচের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা করা হয়েছে  যা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো ও বাতাস প্রবেশ  করতে পারে ।  সমস্ত  ভবনটির গা জুড়ে  বিভিন্ন  রকমের নকশা ফুল, লতা-পাতা ও মটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। কার্ণিশ ও কার্ণিশের  নিচে রয়েছে  অপরূপ নকশা। দক্ষিণ অংশটিতে  অনেক  কারু কাজের  ব্যবহার । এ দিকটাই  ভবনটির সম্মুখ অংশ ।ছয়টি  গোলাকৃতি  স্তম্ভ  ও দুই কোণায় দুইটি চার কোণা  স্তম্ভের নিচ থেকে শেষ  ভাগ পর্যন্ত নকশাখচিত । দক্ষিণ দিকের  অংশের সম্মুখভাগে রয়েছে ৬টি গোলাকার স্তম্ভ।  দুই কোণায়  কোণাকৃতির স্তম্ভে ব্যবহার  করা হয়েছে ব­ক। স্তম্ভগুলির  নিচে থেকে  শেষ পর্যন্ত অলংকৃত । ছাদ এবং কার্নিশের  উপরের  অংশে পাঁচটি প্রধান ও অনেকগুলো মিনারাকৃতি গম্বুজ এর  আদলে  নকশা  রয়েছে যা স্থাপত্যটিকে  অধিক আকর্ষণীয় করেছে। কার্নিশেও বিভিন্ন  ফর্মের ব্যবহার দেখা যায়।

 গোপী নাথ  ও অন্ন  পূর্ন্না মন্দিরঃ নির্মাণকাল ১৭৮৩ খ্রিঃ। নির্মাতা জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন  চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী । মন্দিরটি   স্থাপত্য  শিল্পের অন্যতম  নিদর্শন ।  পাঁচটি কক্ষ বিশিষ্ট মন্দিরটি পদ্মস্তম্ভ দ্বারা  দন্ডায়মান । স্তম্ভ শীর্ষে  ও কার্নিশে ফুল ও লতা পাতার নকশা  সম্বলিত এক অপরূপ  স্থাপত্য। ডরিক ও গ্রীক ভাবধারায়  নির্মিত । বেদীর উপরে  স্থাপিত অনেক গুলো  ধাপে। জানালা গুলোর উপরেও রয়েছে অনেক অলংকার । দক্ষিণ ও পূর্ব পার্শ্বে  উপরের কার্নিশে রাজকীয় মুকুটবিশিষ্ট  তাজিয়া স্থাপন করা হয়েছে যা মৌর্য যুগের স্থাপত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 

লোকনাথ মন্দির ও রঘুনাথ জিওর মন্দিরঃ এ  মন্দিরের  প্রতিমা গুলির একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট  রয়েছে। এটাও বেদীর  উপর স্থাপিত । দর্শনার্থীরা  সহজেই  মন্দিরে প্রবেশ করতে  পারে। দেয়াল, কার্নিশ স্তম্ভ গুলি  ফুল, লতা, পাতার নকশা খচিত নানা রঙে রঞ্জিত করা হয়েছে। এটাও একটি দর্শনীয় প্রাচীন স্থাপত্য । 

জিকে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ঃ নির্মাণ কাল ১৯১৯ সাল ।  প্রতিষ্ঠাতা  জমিদার গোবিন্দ কুমার চৌধুরী। বৃটিশ  ধারায় নির্মিত প্রতিষ্ঠানটিতে  অনেকগুলো পাঠদান কক্ষ, সুপ্রশস্ত জানালা  রয়েছে।  সমস্ত  ভবন টিতে ফর্মের ব্যবহার এমন ভাবে  করা হয়েছে যে, দৃষ্টি  সকল স্থানেই সমান পড়ে । ইটের  গাঁথুনি  দিয়ে  সমস্ত  ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে ।এর সম্মুখভাগের পুকুরটি স্কুলের সৌন্দর্যকে আরো বৃদ্ধি করেছে। এর পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল সবুজের সমাহার । এটি শের আলী গাজি পৌর পার্কের পশ্চিম পাশে অবস্থান করছে। প্রাচীনতম স্থাপনার মধ্যে এটিও জনসাধারণকে মুগ্ধ করে। বারোমারি গীর্জা ও  মরিয়ম নগর গীর্জা দুটিই শেরপুর জেলার নানা ধর্মের  ঐতিহ্য  বহন করে।  স্থাপত্য কলার  অন্যতম  নিদর্শন গীর্জা গুলির নির্মাণে  অনেক কলা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে । শেরপুর  শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যতগুলি স্থাপত্য নির্মাণ হয়েছিল  তার বেশীর ভাগই নির্মাণ হয়েছিল জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা তাদের প্রয়োজনেই। যেমন বাস ভবন, রংমহল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । শিক্ষা ভবনের মধ্যে  শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া  একাডেমী  ১৮৮৭ সালে জমিদার রায় বাহাদুর চারু চন্দ্র চৌধুরী কর্তৃক নির্মিত  ভবনটি ছিল অনিন্দ্য সুন্দর  যা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত ।